শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রশিক্ষণ ক্লাসে শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে শিক্ষকদের নিকট হতে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই একটা অভিযোগ শুনতে হয়। শিক্ষকগণ প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, “এখনকার শিক্ষার্থীরা তো পড়াশুনাই করে না। কারণ তারা জানে যে, পরীক্ষায় গান, কবিতা যাই লিখুক না কেন, তারা নাম্বার পাবেই”। এই কথাটা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রচণ্ড ব্যঙ্গতা আর ক্ষোভ নিয়ে বলে থাকেন।
আমি তখন প্রশ্ন করি, শিক্ষার্থীরা কীভাবে জানল যে, তারা পরীক্ষায় গান, কবিতা যাই-ই লিখুক না কেন তবুও নাম্বার পাবেই। তাদের এই বিশ্বাসটা জন্মালো কী করে? নাম্বার তো আর আকাশ থেকে আসে না বা শিক্ষার্থীরা নিজেদের খাতায় নিজেরা নাম্বার দেয় না বা শিক্ষার্থীরা পরীক্ষকদের মাথায় বন্দুক ধরে নাম্বার নিয়ে আসে না। তাহলে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা কীভাবে এলো যে, পরীক্ষার খাতায় গান, কবিতা যাই লিখুক না কেন, তারা নাম্বার পাবেই? পরীক্ষার খাতা দেখে কারা? নাম্বারটা দেয় কে বা কারা? খাতা দেখে শিক্ষকগণ, নাম্বারও দেন শিক্ষকগণই। তাহলে গান, কবিতা লিখে নাম্বার পাওয়া যায় শিক্ষার্থীদের মনে এই ধারণা জন্মানোর জন্য কারা দায়ী? নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরা নয়। শিক্ষকগণ গান, কবিতায় ভরা খাতায় নাম্বার দেন বলেই তো তাদের ভেতরে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, পরীক্ষার খাতায় গান, কবিতা লিখেও নাম্বার পাওয়া যায়। তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে কেন দোষ দেওয়া হচ্ছে? গান, কবিতা বা হাবিজাবি যা ইচ্ছা লিখে নাম্বার পাওয়া যায় তার জন্য শিক্ষকরাই দায়ী, কোন মতেই শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়।
এ যুক্তি শোনার পরে শিক্ষকগণ তখন অভিযোগ তুলেন যে, শিক্ষা বোর্ড থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন বেশি করে নাম্বার দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। যদি এ কথা সত্যও হয়, তাহলেও তো তার জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী নয় কোনভাবেই। সেটাও বোর্ডের দোষ, তাদের যুক্তি মতে। তাহলে সব কিছুর জন্য আমরা শিইক্ষার্থীদেরকে দায়ী করি কেন? আসল জায়গায় সমস্যা চিহ্নিত না করে শুধু শুধু শিক্ষার্থীদেরকে দায়ী কেন করি?
পরীক্ষার খাতায় গান, কবিতা লিখে নাম্বার পাওয়ার পরিবেশ তো আমরা যারা শিক্ষক বা শিক্ষা বিভাগের সাথে জড়িত তারাই তৈরি করেছি এবং শিক্ষার্থীদের জীবন ও ভবিষ্যত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি। সেই সাথে দেশকেও ভয়াবহ অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি।
যাহোক, তখন পুনরায় প্রশ্ন করি, বোর্ডের কথা আপনারা শুনেন কেন? আপনারা খাতায় যা পাবেন তার ভিত্তিতে নাম্বার দিবেন। তখন তারা বলে, “তাহলে তো পরের বছর আর খাতা দেবে না।” ও আচ্ছা, তাহলে কী দাঁড়ালো? আপনারা ব্যক্তি স্বার্থে বোর্ডের কথা শুনছেন। সততার স্বার্থে নয়। তখন প্রশ্ন করে, “আমাকে না দিলেও অন্য কাউকে খাতা দেবে, সেই শিক্ষকও তো একইভাবে বোর্ডের কথা মতো বেশি করে নাম্বার দিয়ে পাশ করাবে। তাহলে কোনো একজন বা নির্দিষ্ট কেউ খাতা এভোয়েড করে লাভ হলো কী?”
উত্তরে বলি, লাভ লসের হিসেব এভাবে করলে হবে না। সত্যের পক্ষে সবাইকে থাকতে হবে। কোন শিক্ষকই যদি বোর্ডের কথা শুনে বেশি বেশি নাম্বার না দেন, তখন তো বোর্ড কাউকে খাতা না দিয়ে পারবে না। খাতা তো শিক্ষকদেরকে দিতেই হবে। বোর্ড কয়জনকে খাতা না দিয়ে পারবে? সবাই-ই যদি একই পথে থাকি, সত্য, সততা আর ন্যায়ের পক্ষে তখন বোর্ডকেও সত্য, সততা আর ন্যায়ের পক্ষেই থাকতে হবে।
তবে একটা কথা আছে। কোন শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় তার অর্জনের বেস্টটা দিতে পারে না। সব শিক্ষার্থীই যতটুকু জানে বা পড়েছে, পরীক্ষায় তার সবটুকু প্রয়োগ করতে পারে না। এটা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই হয়, হোক সে সবল শিক্ষার্থী বা দূর্বল শিক্ষার্থী। তাই যে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় হয়ত ২৫, ২৬ বা ২৭ পেয়েছে সে কিন্তু ৩৩ পাওয়ায় যোগ্য, যে শিক্ষার্থী ৪৫, ৪৬, বা ৪৭ পেয়েছে সে ৫০ পাওয়ার যোগ্য, যে শিক্ষার্থী ৪৫, ৪৬, ৪৭ বা ৪৮ পেয়েছে সে ৬০ পাওয়ায় যোগ্য, যে শিক্ষার্থী ৭৫, ৭৬, ৭৭, বা ৭৮ পেয়েছে সে কিন্তু ৮০ পাওয়ায় যোগ্যতা রাখে। তাই এসকল ক্ষেত্রে বেশি করে নাম্বার দেওয়ার কথা যদি বোর্ড বলেও থাকে, বোর্ডের সে কথার যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু যে শিক্ষার্থী ২৫, ২৬ বা ২৭ পেয়েছে তাকে নিশ্চয়ই বোর্ড ৫০, ৬০ বা ৮০ নাম্বার দিতে বলে না। তখন তারা আমার এ কথায় একমত হয়।
এবার তাদেরকে প্রশ্ন করি, যদি ধরেও নেই যে, বোর্ড বেশি করে নাম্বার দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পাশ করিয়ে দিতে বলে, তো আপনারা কি চান না যে, আপনাদের শিক্ষার্থীরা সবাই পাশ করুক এবং ভাল নাম্বার নিয়ে পাশ করুক। উত্তর আসে – “চাই”। যদি তাই চান তাহলে তার জন্য কী করা উচিৎ? বোর্ডের নির্দেশ মতো পরীক্ষার খাতায় বেশি করে নাম্বার দিয়ে পাশ করানো উচিৎ? উত্তর আসে “না”। তাহলে কী করতে হবে? উত্তর আসে, তাদেরকে ক্লাসে ভালভাবে পড়াতে হবে।
মনে মনে ভাবি, এবার আসল জায়গায় ঔষধ পড়েছে। হ্যাঁ, আমরা যদি কোর্স চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদেরকে ভালভাবে পড়াই, ভালভাবে পাঠের বিষয়বস্তু বোঝাই তাহলে কোনো পরীক্ষার্থীই পরীক্ষায় খারাপ করবে না। তারা সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে। তখন তারা পরীক্ষায় এমনিতেই ভাল নাম্বার পাবে। তখন বোর্ডকে আর দয়া করে বলতে না হবে না যে, বেশি করে নাম্বার দিয়ে আপনাদের শিক্ষার্থীদেরকে পাশ করিয়ে দিন। শিক্ষার্থীরা নিজের যোগ্যতাতেই নাম্বার অর্জন করবে। এ কথা শোনার পরে শিক্ষকগণ আস্তে আস্তে নিজেদের দায়িত্ব উপলব্ধি করার চেষ্ঠা করেন।
তাহলে কী বোঝা গেল? আমাদের সমস্যা শিক্ষার্থীরা নয়। মূল সমস্যা বোর্ডও নয়। মূল সমস্যা শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরকে সঠিকভাবে পাঠদানে ঘাটতি। আমরা যদি শিক্ষার্থীদেরকে সারা বৎসর ঠিকমতো পড়াতে পারি, গড়ে তুলতে পারি, ঠিক মতো যত্ন নিতে পারি তাহলে শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পাশ করবে এবং ভাল নাম্বার নিয়ে পাশ করবে। কাউকে আর দয়া করে নাম্বার দিতে হবে না। গুনগত মানেরও কোন সমস্যা হবে না। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেতেও কোন সমস্যা হবে না। এডমিশন টেস্টেও তাদের ভরাডুবি হবে না। শিক্ষার্থীদের এই বদনাম ঘাড়ে নিতে হবে না যে, তারা গান, কবিতা যাই লিখে তাতেই নাম্বার পায়, শিক্ষকদেরকেও বোর্ডের চাপে দূর্বল শিক্ষার্থীদেরকে নাম্বার দিয়ে পাশ করিয়ে দিতে হবে না। দূর্বল শিক্ষার্থী বলে আদতে কেউ থাকবেই না। শিক্ষকদের ভাষ্য মতে, বোর্ডকেও আর বলতে হবে না যে, শিক্ষার্থীদেরকে নাম্বার দিয়ে পাশ করিয়ে দিন। শিক্ষার্থীরা নিজের যোগ্যতাতেই পাশ করবে। নিচের ক্লাসে ভালভাবে পড়ে বুঝে পরীক্ষায় পাশ করলে উপরের ক্লাসে গিয়েও শিক্ষার্থীরা আরো ভালভাবে মেধার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটাতে পারবে। পরবর্তীতে শিক্ষা জীবন সমাপ্তি শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতেও দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারবে এবং দেশে ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে মেধা ও যোগ্যতার আলোকে বিভিন্ন পেশা ও কর্মে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
যে শিক্ষার্থীরা সঠিক মেধা, জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে পারে তারা কর্ম ক্ষেত্রেও সঠিক দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে পারে, নৈতিকভাবে পেশাকে পরিচালনা করতে পারে। এত কিছু সম্ভব হয় একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে হাতে-কলমে লেখাপড়া করানোর মাধ্যমেই।
আর যদি শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা জীবনে সঠিকভাবে পাঠদান করা না হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ঘাটতি থাকে আর তাদেরকে নাম্বার দিয়ে দিয়ে পাশ করানো হয় তাহলে তাদের না থাকে জ্ঞান, না গড়ে উঠে কর্ম দক্ষতা, না গড়ে উঠে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ পাঠের বিষয়বস্তু জীবনেরই বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়া হয় জীবনের জন্য, জীবন-কেন্দ্রিক বিষয়বস্তু নিয়ে। শিক্ষার এমন কোন বিষয়বস্তু নেই যা জীবনের সাথে জড়িত নয়, কর্ম বা পেশার সাথে জড়িত নয়। জীবনের জন্যই শিক্ষা। আর সেই শিক্ষাটা যদি ঠিক মতো দেওয়া না হয় তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থীরা শিখবে আর কীভাবে তা জীবনে প্রয়োগ করবে, কীভাবে তাতে তারা সফল হবে?
শিক্ষা জীবনে সঠিক শিক্ষার ঘাটতি থাকে বলেই পরবর্তীতে তার ফলস্বরূপ দেশে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের অনাচার, ব্যভিচার, লুঠতরাজ, ছিনতাই, লোক ঠকানোর ফাঁদ পাতা, বেকারত্ব, বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে হয়রানি, ত্রুটি, গাফিলতি, প্রতারণা, মাদক সেবন, চোরা চালান, দায়িত্বে অবহেলা, অসহিষ্ণুতা, অসহযোগিতা, অসহমর্মীতা, অসাধুতা, অসততা, অসমতা, অদক্ষতা, অসফলতা, অনুৎপাদনশীলতা, অন্যায়, অত্যাচার, নৈরাজ্য ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। দেশ তার কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। কারণ দেশ ও দশের সুখ, শান্তি, সম্মৃদ্ধি, উন্নয়ন সব কিছু নির্ভর করে দেশের গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এবং শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির উপর।
তাই সমস্যার আসল জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে সঠিকভাবে পড়াতে হবে, সঠিকভাবে পাঠের বিষয়বস্তু আয়ত্ব করাতে হবে, শিক্ষার বিষয়বস্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হাতে-কলমে ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে শেখাতে হবে। তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সঠিক পরিকল্পনা করে শিক্ষার্থীদেরকে সারা বৎসরব্যাপী শেখানোর কার্যক্রম চালাতে হবে, চূড়ান্ত মূল্যায়নের আগে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে বারবার তাদের ঘাটতি চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রান্তিক মূল্যায়ন বা পাবলিক পরীক্ষার আগেই তাদেরকে চূড়ান্ত পরীক্ষার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আর এ দায়িত্ব শিক্ষকদেরকেই সঠিকভাবে এবং আন্তরিকতার সাথে পালন করতে হবে।
লেখকঃ
মোছাঃ নাসিমা খাতুন
সহকারী পরিচালক
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (HSTTI), রাজশাহী।